মনিপুর রাজ্যের অশান্তি: একটি বিশ্লেষণ
Ashim Datta 11/09/2024
Hello - 9366610181
মনিপুর, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একটি ছোট রাজ্য, বিগত কয়েক দশক ধরে রাজনৈতিক অস্থিরতা, জাতিগত সংঘাত ও সশস্ত্র বিদ্রোহের কারণে অশান্তিতে জর্জরিত। যদিও এই রাজ্যের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সংস্কৃতি বৈচিত্র্য রয়েছে, তা সত্ত্বেও দীর্ঘদিন ধরে এখানকার মানুষের জীবনযাত্রা এই সংঘাতময় পরিস্থিতির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। মনিপুরের বর্তমান অশান্তি বহুমাত্রিক এবং এর শিকড় গভীরভাবে ঐতিহাসিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে প্রোথিত।
১. জাতিগত ও সাম্প্রদায়িক সংঘাত
মনিপুরের জনগণের মধ্যে বেশ কয়েকটি বড় জাতিগোষ্ঠী রয়েছে, যেমন মেইতেই, নাগা, কুকি প্রভৃতি। মেইতেইরা রাজ্যের সমতল অঞ্চলে বসবাস করে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় হিসেবে রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অন্যদিকে, কুকি ও নাগা সম্প্রদায় পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাস করে। এই জাতিগোষ্ঠীগুলির মধ্যে ভূমি, ক্ষমতা ও সাংস্কৃতিক অধিকার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সংঘাত চলছে। মূলত ভূমি ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে এই জাতিগত দ্বন্দ্বগুলি তীব্র হয়েছে, যা রাজ্যের শান্তি নষ্ট করেছে।
২. সশস্ত্র গোষ্ঠী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন
মনিপুরে একাধিক সশস্ত্র গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে, যারা বিভিন্ন সময়ে স্বাধীনতা, স্বায়ত্তশাসন, অথবা বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদার দাবি জানিয়েছে। এদের মধ্যে ইউনাইটেড ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট (UNLF), পিপলস লিবারেশন আর্মি (PLA), কুকি ন্যাশনাল আর্মি (KNA) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এই গোষ্ঠীগুলি ভারত সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছে এবং রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্রোহী কার্যকলাপ পরিচালনা করছে। সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলির ক্রমাগত হিংসাত্মক কার্যকলাপ ও ভারত সরকারের বিরুদ্ধে পরিচালিত আন্দোলন মনিপুরের অস্থিরতার প্রধান কারণগুলির একটি।
৩. ভূমি ও রাজনীতির দ্বন্দ্ব
মনিপুরের পাহাড়ি এবং সমতল অঞ্চলের মধ্যে ভূমি নিয়ে সংঘাত দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীগুলি সমতল অঞ্চলের মানুষের আধিপত্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে এবং তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষার জন্য লড়াই করছে। সমতল অঞ্চলের মেইতেইরা পাহাড়ি অঞ্চলে প্রবেশাধিকারের দাবি জানালে, পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে এর বিরুদ্ধে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এর ফলে ভূমি নিয়ন্ত্রণ, বসতি ও আধিপত্য নিয়ে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘাত আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
৪. নিরাপত্তা বাহিনী ও মানবাধিকার লঙ্ঘন
মনিপুরে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও আধাসামরিক বাহিনীর ব্যাপক উপস্থিতি রয়েছে, কারণ অঞ্চলটি বহুদিন ধরে সংঘাতময়। তবে সেনাবাহিনী ও সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলির মধ্যে সংঘর্ষের পাশাপাশি, সাধারণ মানুষও মাঝে মাঝে সংঘাতের শিকার হয়েছেন। বিশেষ করে, আফস্পা (AFSPA) আইন মনিপুরের অনেকাংশে প্রয়োগ করা হয়েছে, যা মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে সমালোচিত হয়েছে। এই আইন সেনাবাহিনীকে অতিরিক্ত ক্ষমতা প্রদান করে, যা অনেক ক্ষেত্রেই নিরপরাধ মানুষের অধিকার লঙ্ঘনের কারণ হয়েছে।
৫. শান্তি প্রক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ
ভারত সরকার মনিপুরের অস্থিরতা নিরসনের জন্য বিভিন্ন সময়ে শান্তি আলোচনা ও উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তবে জাতিগত বিভাজন, সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলির ভূমিকা, এবং স্থানীয় রাজনৈতিক জটিলতা প্রক্রিয়াটিকে বাধাগ্রস্ত করেছে।
মনিপুরের স্থায়ী শান্তি অর্জন করার জন্য প্রয়োজন, সকল জাতিগত গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করা, অস্ত্রধারী গোষ্ঠীগুলির সাথে ফলপ্রসূ আলোচনা করা, এবং মানুষকে উন্নয়নের মূলধারায় যুক্ত করার প্রচেষ্টা।
উপসংহার
মনিপুরের অস্থিরতার পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিনের ইতিহাস, সংস্কৃতি, এবং রাজনৈতিক সংঘাত। একদিকে ভারতের অখণ্ডতার প্রশ্ন, অন্যদিকে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর আত্মপরিচয় ও অধিকার রক্ষার লড়াই—এই দ্বৈত সমস্যার সমাধান একদিনে সম্ভব নয়। তবুও, শান্তি ও সংহতির জন্য সকল পক্ষের যৌথ প্রচেষ্টা অপরিহার্য।
No comments:
Post a Comment