Sunday, July 6, 2025

ডিজিটাল প্রযুক্তির ছোঁয়ায় ভারতের শিক্ষাক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন

ডিজিটাল প্রযুক্তির ছোঁয়ায় ভারতের শিক্ষাক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন




প্রতিবেদন : অসীম দও, কৈলাসহর



গত এক দশকে ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থায় এসেছে এক অভূতপূর্ব রূপান্তর। প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতির ফলে, যে শিক্ষা একসময় শুধুমাত্র বই-খাতা, ব্ল্যাকবোর্ড আর শ্রেণিকক্ষের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, আজ তা পৌঁছে গেছে মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, ট্যাবলেট, স্মার্ট ক্লাসরুম এবং অনলাইন কোর্সের মাধ্যমে ঘরে ঘরে। ডিজিটাল প্রযুক্তি শিক্ষাকে করে তুলেছে আরও সহজ, গণমুখী, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সময়োপযোগী।
২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে “ডিজিটাল ইন্ডিয়া” কর্মসূচি শুরু হওয়ার পর থেকেই শিক্ষা খাতকে প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত করার এক বিশাল উদ্যোগ নেওয়া হয়। NEP 2020 (জাতীয় শিক্ষা নীতি) অনুসারে শিক্ষা হবে বহুমুখী, প্রযুক্তিনির্ভর ও দক্ষতা ভিত্তিক।
সরকার চালু করে একাধিক ডিজিটাল শিক্ষামূলক প্ল্যাটফর্ম:
DIKSHA (Digital Infrastructure for Knowledge Sharing): এই প্ল্যাটফর্মে ৩৫টি ভাষায় বিভিন্ন ক্লাসের ই-বুক, ভিডিও লেকচার, কুইজ ও মূল্যায়ন ব্যবস্থা রয়েছে। আজ পর্যন্ত ৫০ কোটি শিক্ষার্থী এই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করেছে।
SWAYAM (Study Webs of Active Learning for Young Aspiring Minds): উচ্চশিক্ষার্থীদের জন্য ফ্রি অনলাইন কোর্স। এখানে ২০০০-এরও বেশি কোর্স রয়েছে।
e-Pathshala: NCERT-এর ডিজিটাল পাঠ্যবই, অডিও, ভিডিও, কুইজ সহ একটি সম্পূর্ণ অ্যাপ। PM eVIDYA: One Nation One Digital Platform - এর অংশ হিসেবে সারা দেশে ‘চান্দা টিভি’ চ্যানেলে শ্রেণি অনুসারে পাঠ সম্প্রচার। এছাড়া রাজ্য সরকারগুলিও (যেমন: কেরালা, তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র, দিল্লি) নিজেদের মতো করে ডিজিটাল শিক্ষার ব্যবস্থা চালু করেছে।
২০২০ সালের মার্চে কোভিড-১৯ মহামারির কারণে যখন দেশের সব স্কুল-কলেজ বন্ধ হয়ে যায়, তখন অনলাইন শিক্ষা ছিল একমাত্র ভরসা। Zoom, Google Meet, Microsoft Teams-এর মতো ভিডিও প্ল্যাটফর্মে শিক্ষকেরা ঘরে বসে শিক্ষাদান শুরু করেন।
সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে হাজার হাজার অনলাইন কোর্স তৈরি হয়। শিশুরাও প্রথমবার অনলাইন পরীক্ষায় অংশ নেয়, এবং অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল অ্যাসাইনমেন্ট চালু হয়।
এক জরিপে দেখা গেছে: ২০২০-২১ সালের মধ্যে ভারতে ২৪ কোটি শিক্ষার্থী অনলাইন শিক্ষায় অংশ নেয়। BYJU’S, Vedantu, Unacademy-এর মতো অ্যাপগুলোতে ২০২১-২২ সালে ব্যবহারকারী বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ১০ কোটিতে। ইউটিউবে শিক্ষাবিষয়ক চ্যানেলগুলোর দর্শকসংখ্যা বৃদ্ধি পায় ২০০%।
প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষায় শিক্ষকদের ভূমিকা বদলেছে। আগে যেখানে শুধু মুখে বোঝানো হতো, এখন ভিডিও, অ্যানিমেশন, মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে বোঝানো হয়। তাই শিক্ষককেও প্রযুক্তিতে দক্ষ হতে হচ্ছে। সরকার CBSE ও NCERT-এর মাধ্যমে শিক্ষক প্রশিক্ষণের ডিজিটাল কোর্স চালু করেছে। এখন পর্যন্ত DIKSHA-তে ৪০ লাখেরও বেশি শিক্ষক প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেছেন। ভারত আজ বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ EdTech (Education + Technology) হাব। বেশ কিছু উদ্ভাবনী প্রতিষ্ঠান শিক্ষাকে ব্যবসার গণ্ডি ছাড়িয়ে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছে।
উদাহরণ হিসাবে, BYJU’S: বর্তমানে ১৫ কোটিরও বেশি শিক্ষার্থী যুক্ত। ইন্টার‌্যাক্টিভ ভিডিও, কুইজ, লাইভ ক্লাসের মাধ্যমে শেখায়।  Vedantu: ভারচুয়াল লাইভ ক্লাস সিস্টেম, স্কুল ও জেইই/নিট প্রস্তুতির জন্য জনপ্রিয়।
Unacademy: UPSC সহ প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতিতে অগ্রণী। PhysicsWallah: মধ্যবিত্ত ও গ্রামীণ শিক্ষার্থীদের জন্য সুলভ মূল্যে উচ্চমানের অনলাইন শিক্ষা।
 ডিজিটাল শিক্ষার উপকারিতাও আছে অনেক, গ্রাম থেকে শহর, সবখানেই এক মানের শিক্ষা পাওয়া সম্ভব ।  যাতায়াত ছাড়াই ক্লাস করা যায় । ভিডিও, কুইজ, ই-বুক ইচ্ছেমতো সময়ে দেখা ।
কুইজ, এসাইনমেন্টের মাধ্যমে দ্রুত ফলাফল ।  কোডিং, ডাটা অ্যানালিটিক্স, ডিজাইন প্রভৃতি আধুনিক বিষয়ে কোর্স সহজলভ্য
তবে প্রযুক্তির এই জয়যাত্রার মাঝেও রয়েছে কিছু বাধা, গ্রামীণ ভারতে এখনও ৪৫% শিক্ষার্থীর নেই স্মার্টফোন বা নিরবিচ্ছিন্ন ইন্টারনেট । ধনী-গরিব, শহর-গ্রাম—এই ব্যবধান ডিজিটাল বিভাজন সৃষ্টি করছে । শিক্ষকের প্রযুক্তি জ্ঞান সীমিত: অনেক প্রবীণ শিক্ষক অনলাইন ক্লাস নিতে দ্বিধাগ্রস্ত । অনলাইন প্ল্যাটফর্মে পড়াশোনার পরিবর্তে গেমিং ও সোশ্যাল মিডিয়ায় আসক্তির ঝুঁকি ।অনলাইন পরীক্ষায় নকল বা ফাঁকি দেওয়া সহজ ।
চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার ও সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রয়োজন: সকলের জন্য সাশ্রয়ী ডিভাইস ও ইন্টারনেট, ডিজিটাল শিক্ষায় বিনামূল্যে প্রবেশাধিকার,
গ্রামে ডিজিটাল অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ,  শিশুদের নিরাপদ ও নিয়ন্ত্রিত প্রযুক্তি ব্যবহার নিশ্চিতকরণ ।
জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০২০ অনুযায়ী, ভবিষ্যতের শিক্ষা হবে "Tech-enabled blended learning", অর্থাৎ অনলাইন ও অফলাইন শিক্ষার সমন্বয়ে। ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি (VR), কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), মেশিন লার্নিং (ML)-এর মতো প্রযুক্তি শিক্ষা ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে।
ভারতের শিক্ষাক্ষেত্রে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার ভবিষ্যতের পথনির্দেশক। সঠিক পরিকল্পনা, প্রশিক্ষণ, অবকাঠামো ও সমতার ভিত্তিতে ডিজিটাল শিক্ষা হতে পারে ভারতের ১৩৫ কোটির মানুষের জ্ঞান ভিত্তিক উন্নয়নের ভিত্তি। আজকের শিক্ষার্থী প্রযুক্তিকে যথাযথভাবে ব্যবহার করলে সে শুধু চাকরি নয়, বরং উদ্ভাবনের পথে এগিয়ে যাবে—আর এভাবেই গড়ে উঠবে এক আত্মনির্ভর, প্রযুক্তিনির্ভর, আধুনিক ভারত ।


No comments:

Post a Comment

Awareness Programme on Road Safety at Unakoti KalaKshetra

Awareness Programme on Road Safety at Unakoti KalaKshetra Correspondent: Ashim Datta, Kailashahar An exceptional awareness progr...